প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন। বাংলাদেশ অংশের ৬০১৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই বনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং দর্শনীয় স্থান হলো পূর্ব বনবিভাগের বাগেরহাটের শরণখোলা রেঞ্জ। দুই ধারে ঘন জঙ্গলের মাঝ থেকে বয়ে চলা এখানকা আকাবাঁকা নদী-খাল আর বন্যপ্রাণির অবাধ বিচরণ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সবসময়ই আকৃষ্ট করে। তাই তারা দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ছুঁটে আসেন এখানে।
শরণখোলার এই বনের কটকা, কচিখালী, সুপতি, দুবলা, আলোরকোল, কোকিলমণি, টিয়ারচরসহ রয়েছে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। শরণখোলা থেকে সহজ পথে খুব কম খরচে এবং অল্পসময়ে এসব দর্শনীয়স্থান ঘুরে আসা যায়। অথচ সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের অভাবে এবং প্রচার-প্রচারণা না থাকায় পর্যটন শিল্প বিকাশের এই অপার সম্ভাবনাময় খাতটি পেছনে পড়ে আছে। সুন্দরবন ভ্রমণের এই সহজ রুট সম্পর্কে ব্যাপক পরিচিতি না থাকায় পর্যটকরা অধিক সময় ও অর্থ খরচ করে খুলনা ও মোংলা রুট দিয়ে শরণখোলার বনে প্রবেশ করে।
অথচ, সরকার ২০১০ সালে পর্যটন শিল্পকে অগ্রাধিকারমূলক খাত হিসেবে চিহ্নিত করে জাতীয় পর্যটন নীতিমালা প্রণয়ন, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড প্রতিষ্ঠা এবং পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করলেও সুন্দরবনের শরণখোলা এলাকায় এর কোনো প্রভাব পড়েনি।
তবে, পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জটিকে কেন্দ্র করে যদি পর্যটন কর্পোরেশন উদ্যোগ গ্রহণ করতো, তাহলে বনের ওপর নির্ভশীল পেশাজীবীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতো। অবহেলিত এ এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটতো এবং বিশ্ব ঐতিহ্য ও পৃথিবী বৃহত্তম এ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেতো।
শরণখোলা রেঞ্জের আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় স্থানসমুহ এবং বিস্তারিত
কটকা : সুন্দরবনের আকর্ষণীয় সব স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি স্পট হলো শরণখোলা রেঞ্জের কটকা বনাঞ্চল। বন্য জীবজন্তু, মৎস্য ও জলজ প্রাণির প্রজননের জন্য এটি অভযারণ্য হিসেবে ঘোষিত। এখানকার জামতলায় রয়েছে একটি ওয়াচ টাওয়ার। টাওয়ার থেকে দেখা যায় বনের উপরিভাগের বিশাল সবুজ ঘন জঙ্গল। ভাগ্য প্রসন্ন হলে দেখা মিলতে পারে রাজকীয় ভঙ্গিতে ডোরাকাটা রয়েল বেঙ্গলের শরীর দুলিয়ে হেঁটে চলা। জামতলার পাশেই রয়েছে বিশাল সি-বিচ। এই বিচে আছড়ে পড়ে বঙ্গোপসাগরের বড় বড় ঢেউ। যেখানে একই সাথে উপভোগ করা যায় কক্সবাজার ও কুয়াকাটা সৈকতের আনন্দ আর সুন্দরবনের সৌন্দর্য্য।
কটকা বনঅফিসের আশপাশে মায়াবি চিত্রল হরিণের অবাধ বিচরণ, বানরে ছুঁটোছুঁটি সব ক্লান্তি ভুলিয়ে দেবে। অফিসের পেছনে রয়েছে প্রায় ২০০মিটার দীর্ঘ একটি ফুটট্রেইল। ট্রেইলের মাথায় গেলেই খুব কাছ থেকে দেখা যাবে হরিণের মেলা। ইচ্ছে করলে হরিণের সাথে সেলফিও তোলা সম্ভব। পর্যটকদের রাত্রিযাপনের জন্য বনবিভাগের একটি রেস্টহাউজ রয়েছে। যেখানে রয়েছে নিরাপদে থাকার সু-ব্যবস্থা । তবে, থাকতে হলে বনবিভাগের পূর্ব অনুমোতি নিতে হবে।
কচিখালী : কটকার মতো কচিখালীতেও রয়েছে একটি রেস্টহাউজ। এই রেস্টহাউজে বসেই উপভোগ করা যায় সাগরের ঢেউয়ের মূর্ছনা, বণ্য পাখপাখালির কোলাহল, হরিণ-বানরের সখ্যতা। এখানে রয়েছে বিশাল সনের (সন ঘাস) বাগান। সন ঘাসে বাতাস হৃদয় জুড়ানো ঢেউ খেলে যায়। এই সন বাগান বাঘ, হরিণসহ বন্যপ্রাণির অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। এখানেও রয়েছে বিশাল সি-বিচ।
সুপতি : এটিও অভয়ারণ্য এলাকা। এখানের নদীতে দুর্লভ প্রজাতির ইরাবতী ডলফিনের দেখা মেলে। ছোট ছোট খালের দুই পাশে সারিবদ্ধ গোলপাতার বন পর্যকদের আকৃষ্ট করে। নিরাপত্তার জন্য বনবিভাগ ও কোস্টগার্ডের ক্যাম্প রয়েছে। এখানকার সৌন্দর্য উপভোগ করে দিনে দিনে ফিরে আসা যায়।
দুবলা ও আলোর কোল : শুঁটকি পল্লীর জন্য বিখ্যাত। বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে গড়ে ওঠা দুবলার জেলে পল্লীর অধীনে ছোটবড় আটটি চরেই শুঁটিক উৎপাদন হয়। প্রতিবছর অক্টোবর থেকে মার্চ এই পাঁচ মাস চলে শুঁটকি প্রক্রিয়ার কাজ। প্রতিবছর রাস পূর্ণিমায় আলোরকোলে জমে ওঠে রাস উৎসব। এ উৎসবে দেশি-বিদেশি লাখো পর্যটকের সমাগম ঘটে। এখানকার বিশাল সি-বিচ থেকে সুর্য্য ওঠা, সুর্যাস্ত দেখা যায়। অসংখ্য গাঙচিলের কলোকাকলিতে সারাক্ষণ মূখর থাকে পরিবেশ। আর যেতে যেতে দেখা মিলবে সাগরে অসংখ্য জেলি ফিশের। দুবলাতে বনবিভাগের পাশাপাশি র্যাব ও কোস্টগার্ডের ক্যাম্প রয়েছে। ওখানে রাত্রিযাপন করতে হলে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় থাকতে হবে।
কোকিলমণি ও টিয়ারচর : এই স্থান দুটি হলো সুন্দরবনের সবচেয়ে গভীরতম স্থান। বন্যপ্রাণির অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। কোকিলমণিতে রয়েছে স্বচ্ছ ও মিষ্টি পানির এক বিশাল দীঘি। নোনা পানি বিধৌত এ সুন্দরবনের মধ্যে মিষ্টি পানিতে পর্যটকরা ইচ্ছে করলে অবসাদ ও ক্লান্তি দূর করার জন্য গোসল সেরে নিতে পারেন। এখানে নিরাপত্তার জন্য বনবিভাগ ও কোস্টগার্ডে অফিস রয়েছে। টিয়ারচরের হরিণের অবাধ বিচরণ দেখা যায়। এ ছাড়া বনমোরগ, শুকর, গুঁইসাপ, মদনটাক, বাজপাখিসহ অসংখ্য সরিসৃপের দেখা মেলে।
ভ্রমণের সহজ রুট
শরণখোলায় আসতে হলে প্রথমে ঢাকার সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে আসতে হবে। সেখানে ফালগুনি, পর্যটক, হামিম, গ্রামীণ, মেঘনা, ইমা, বনফুলসহ ১০-১২টি বিভিন্ন কম্পানির পরিবহনের বিলাশবহুল বাস রয়েছে। এসব পরিবহনে টিকিট কেটে সরাসরি শরণখোলা উপজেলা সদর রায়েন্দা এসে পৌঁছানো যায়। মীরপুর থেকেও বিশে কিছু পরিবহন আসে এখানে। আবার নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্য মতো প্রাইভেট গাড়িতেও আসতে পারে যে কেউ। রায়েন্দাতে রাত্রিযাপনের জন্য সরকারি ডাকবাংলো, আবাসিক হোটেল রূপসী রায়েন্দা, সুন্দরবন অবকাশ, পিংকিসহ বেসরকারি বেশ কয়েকটি রেস্ট হাউজ রয়েছে। এ গুলোর মধ্যে কিছু শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষও রয়েছে।
সুন্দরবনে যাওয়ার জন্য বেসরকারি সংস্থা জোয়ার ট্যুরিস্ট সেন্টারের সাথে যোগাযোগ করলে (মোবাইল নম্বর- ০১৭১২৮৭৩৭৩১) তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় থাকা-খাওয়াসহ নিরাপদে ভ্রমণ করা যাবে। তাছাড়া রায়েন্দা থেকে ইঞ্জিন চালিত ট্রলার বা লঞ্চে করে সীমিত ভাড়ায় সুন্দরবনের এসব এলাকা ভ্রমণ করা যায়। চাইলে দিনে দিনেও কটকা, কচিখালাী, সুপতির দর্শনীয় স্থানগুলো ভ্রমণ করে ফিরে আসা যাবে।
এ ব্যাপারে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জ কর্মকর্তা (এসিএফ) মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের লোকালয় থেকে কাছাকাছি আলীবান্দা এলাকায় মোংলার করমজলের আদলে একটি ট্যুরিস্ট স্পট করার প্রক্রিয়া চলছে। এখানে হরিণ, কুমরিসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণি থাকবে। একটি দীর্ঘ ফুটট্রেইল নির্মাণ করা হবে। যার মাধ্যমে পর্যটকরা পায় হেঁটে এসব দেখতে পারবেন। যারা দিনে দিনে সুন্দরবন ভ্রমণ করে ফিরতে চান তাদের জন্য এটি বেশ আনন্দদায়ক হবে।
সূত্র : কালের কণ্ঠ
Discussion about this post