আপ্তাব উদ্দিনের ছয় সন্তানের মধ্যে একমাত্র ছেলে জাকির হোসেন। জাকির ছিলেন কিছুটা দূরন্ত স্বভাবের। এক ছেলে বলে বাবা কখনো জাকিরকে শাষণ করতেন না। জাকিরও ছিলেন সবার আদরের। তবে পরোপকারী। সেই জাকির চেয়েছিলেন পরিবারের হাল ধরতে। বাবার একটু কষ্ট গোছাতে। পরিবারে আরো একটু স্বচ্ছলতা আনতে। মা-বাবা আর বোনদের মুখে হাসি ফুটাতে। এজন্যই হয়তো প্রায় নয় মাস আগে বাড়ি ছেড়েছিলেন জাকির। উদ্দেশ্য ছিল মরক্কো থেকে স্পেনে যাওয়া। কিন্তু স্পেনে আর যাওয়া হয়নি জাকিরের।
নৌকায় মরক্কো থেকে স্পেন যাওয়ার পথে ভূমধ্য সাগরে নৌকাডুবির ঘটনায় মৌলভীবাজারের বড়লেখার দুই যুবক নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের একজন জাকির হোসেন (২৮)। অপর যুবকের নাম জালাল উদ্দিন (২৯)। জাকির বড়লেখা উপজেলার দাসেরবাজার ইউনিয়নের সুড়িকান্দি গ্রামের আপ্তাব আলীর ছেলে। আর জালাল উপজেলার নিজবাহাদুরপুর ইউপির পকুয়া গ্রামের জোয়াদ আলীর ছেলে। নৌকাডুবির পর থেকে জাকির ও জালালের কোনো খোঁজ মিলছে না। এতে চরম উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় রয়েছে তাদের পরিবার।
তাদের পরিবার জানিয়েছে, গত ২৬ নভেম্বর দিবাগত রাতে নৌকায় মরক্কো থেকে স্পেন যাওয়ার পথে ভূমধ্য সাগরে যে নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে। সেটিতে জাকির ও জালাল ছিলেন। তবে তারা দুজন এখনো বেঁচে আছেন কিনা মারা গেছেন সে ব্যাপারে সঠিক কোনো তথ্য বলতে পারছেন না তারা।
এদিকে স্পেনের স্থানীয় গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে প্রবাসী একটি সূত্র জানিয়েছে, সাগরপথে নৌকায় মরক্কো থেকে স্পেন যাওয়ার পথে নৌকাডুবির ঘটনায় ৪ জন মারা গেছেন। নিখোঁজ রয়েছেন ১৬ জন। উদ্ধারকারী দল ৫৮ জনকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করেছে। তবে নিহত বা আহত কারোই নাম পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি। তবে প্রবাসী ওই সূত্রটি ধারণা করছে, নিহতদের মধ্যে জাকির ও জালাল থাকতে পারেন।
সরেজমিনে দাসেরবাজার ইউপির সুড়িকান্দি গ্রামে জাকিরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, জাকিরের কোনো যোগাযোগ না পেয়ে ভেঙে পড়েছে তাঁর পরিবার। মা আর বোনরা বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন। কেউ কোনো কথা বলতে পারছেন না। স্বজনরা তাদের সান্তনা দিচ্ছেন। জাকিরের প্রতিবেশীরা জানালেন, তারা শোনেছেন যে জাকির মারা গেছেন। তবে তারা কেউই একথা বিশ্বাস করতে পারছেন না। আর জাকিরের বাবা আপ্তাব আলী ছেলের কথা বলতে গিয়ে ঢুকরে কেঁদে ওঠলেন। কান্না চেপে তিনি বলেন, ‘জাকির আছে না মারা গেছে আমরা কোনো কিছু জানি না। তবে অনেকে বলাবলি করছে যে সে মারা গেছে। স্পেনের হাসপাতালে আত্মীয়-স্বজনরা খোঁজ করেছেন। কিন্তু তাঁকে পাননি। আর কিছু বলতে চাই না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো খবর পেলে আপনাদের জানাবো। একমাত্র ছেলে আমার। আমি চাইনি সে (জাকির) বিদেশ যাক। কিন্তু সে আমার কথা শোনেনি। এক ছেলে, তাই আমিও আর ওকে বাধা দেইনি। ছেলে আমার মানুষের উপকার করেছে। সেজন্য মানুষজন খবর পেয়ে বাড়িতে ছুটে আসছেন।’ জাকির কীভাবে মরক্কোতে গেলেন সে ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো কিছু বলতে চাননি।
জাকিরের চাচাতো ভাই সাইফুল আলম বলেন, ‘জাকির আছে না মারা গেছে ঠিক জানি না। তবে কেউ কেউ বলছেন সে নাকি মারা গেছে। কিন্তু আমরা সেখানকার হাসপাতালে খোঁজ করিয়েছি। তাকে পাওয়া যায়নি। আমাদের ধারণা, সে হয়তো বেঁচে আছে। সে খুব ভালো ছেলে ছিল। অনেক মানুষের উপকার করেছে। কোনোদিন কারো ক্ষতি করেনি।’
এদিকে নিজবাহাদুরপুর ইউপির পকুয়া গ্রামের জালাল উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছেলের কোনো খোঁজ না পেয়ে ভেঙে পড়েছেন বাবা-মা। এ সময় কথা হয় জালালের বড় ভাই জিলাল উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, জালাল তিন বছর আগে সৌদিতে যান। তাঁর আরো দুই ভাই সৌদিতে থাকেন। তাদের সঙ্গে থাকতেন জালাল। সেখান থেকে তিনি কয়েক মাস আগে স্পেন যাওয়ার উদ্দেশে মরক্কোতে যান। কিন্তু কীভাবে আর কার মাধ্যমে মরক্কোতে গেলেন তা তিনি বলতে পারছেন না।
সূত্র জানায়, জাকির হোসেন চলতি বছরের মার্চ মাসে এক দালালের মাধ্যমে স্পেন যাওয়ার জন্য চুক্তি করেন। এরপর চুক্তি অনুযায়ী প্রথমে যান ভারতে। সেখানে কিছুদিন থাকার পর পাড়ি দেন আলজেরিয়ায়। পরে যান মরক্কোতে। একইভাবে স্পেন যাওয়ার জন্য সৌদিতে এক দালালের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন জালাল উদ্দিন। কিন্তু কয়েকবার চেষ্টা করেও দালালরা তাদের স্পেনে পৌঁছে দিতে পারেনি। সর্বশেষ গত ২৬ নভেম্বর দিবাগত রাতে ৭৮ জন যাত্রী নিয়ে একটি নৌকা ভূমধ্য সাগর পথে মরক্কো থেকে স্পেন যাওয়ার জন্য রওয়ানা দেয়। কিন্তু ভূমধ্য সাগরে ডুবে যায় তাদের বহনকারী নৌকাটি। এরপর থেকে জাকির ও জালালের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে বড়লেখা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. ইয়াছিনুল হক শনিবার (৩০ নভেম্বর) বিকেলে বলেন, বিষয়টি জানা নেই। কেউ আমাদের কাছে অভিযোগও করেনি। তবে কারো পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ পেলে তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র : কালের কণ্ঠ
Discussion about this post