কথা বলছেন সিদ্দিক আহমেদ, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অভিযানে পালিয়ে আসা একজন মিয়ানমারের নাগরিক।
ছবি তুলেছেনঃ আলী আহমেদ।
পাইউমং চৌধুরী
# সিদ্দিক আহমেদের বয়স ৬৫ বছর। মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটের মংডু শহরের সবুজে ঘেরা মনোরম ডুম্বাই গ্রামে বসবাস করতেন। স্বামী-স্ত্রী, ৮ ছেলে, ২ মেয়ে নিয়ে ১২ জন সদস্যের পরিবার তার।কৃষিকাজ ও বাঁশ-কাঠের ব্যবসা করে কোনমতে চলত সংসারের চাকা। বাবার কাজে সহায়তার পাশাপাশি ছেলেরাও কিছু অর্থ উপার্জন করে সংসারের প্রয়োজন মেটাত, আর মেয়েরা ঘরের কাজে সহায়তা করত মা’কে । মিয়ানমার সামরিক বাহিনী রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন ও গণহত্যা শুরু করলে প্রাণ বাঁচাতে অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে স্বপরিবারে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। প্রথমদিকে বিভিন্ন জায়গায় অস্থায়ীভাবে ঠাঁই হলেও এখন স্বপরিবারে ঠাঁই হয়েছে কক্সবাজারের উখিয়ার হাকিমপাড়া ক্যাম্প ১৪ এর ২ নং ব্লকে। সরকার ও বিভিন্ন এনজিও সংস্থার ত্রাণ নিয়ে পরস্পর লাগোয়া জনাকীর্ণ ঝুপরি ঘরগুলোতে গাদাগাদি করে কোনরকমে দিন যাপন করছেন। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা ভেবে মাঝে মাঝেই আনমনা হয়ে যান, হাজারো দুশ্চিন্তা ভীর করে মাথায়। কথাপ্রসঙ্গে বলেন, নিজেদের নিয়ে নয়, বয়স হয়েছে, ক’দিন আর বাঁচি ঠিক নেই, ছেলে-মেয়েসহ নতুন প্রজন্মের জন্যই বেশি দুশ্চিন্তা হয়। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা লার্নিং সেন্টারে(স্কুলে) গেলেও, উঠতি যুবক-যুবতীদের জন্য তেমন কোন কর্মসূচী না থাকায় তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে দিনকে দিন।খোশগল্পে ও মোবাইলে অলস সময় কাটায়, অনৈতিক ও অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়, নিজেদের মধ্যে ও স্থানীয়দের সাথে ঝগড়া বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। কুচক্রী মহলের ফাঁদে পা দিচ্ছে, গুজবে কান দিচ্ছে এবং গুজব রটাচ্ছে।
একদিকে তাদের প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হচ্ছে, অন্যদিকে স্থানীয়দের মধ্যে তাদের প্রতি ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। এর একটা টেকসই সমাধান কবে কিভাবে হবে কিছুই ভেবে পান না। এরই মধ্যে একদিন তাদের প্রতিবেশী মোঃসেলিম তাদের কাছে এসে ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’ প্রকল্পের কথা জানান। ‘ইউএনএইচসিআর’ এর সহায়তায় ‘কোস্ট ট্রাস্ট’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। যেটি কিনা প্রত্যাবাসনের আগপর্যন্ত রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মধ্যে ‘দ¦ন্দ্ব নিরশন’ ও ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে’র উন্নয়নে কাজ করছে। পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করছে। এ লক্ষ্যে তারা স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত ‘সামাজিক সংযোগ কমিটির’ ক্যাম্প পরিদর্শন, রোহিঙ্গা মাঝি, ইমাম, যুবকদের সাথে সচেতনতামূলক আলোচনা সভা(এফজিডি) শেষে এ আলোচনার বিষয়ে এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান উন্নয়নে প্রাপ্ত সুপারিশ সংশ্লিষ্ট ক্যাম্প ইন-চার্জকে অবহিত করার পাশাপাশি তার মূল্যবান মতামত এবং পরামর্শও গ্রহণ করেন। প্রকল্পের কর্মীরাও মানবিক মর্যাদা, মানবাধিকার, শরণার্থী অধিকার, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বিষয়ে সচেতনতামূলক সেসন পরিচালনা করছেন। এছাড়াও বিভিন্ন বয়সী ক্যাম্প অধিবাসীদের জন্য খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগীতার আয়োজন করছেন।
সিদ্দিক আহমেদ আরো বলেন ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’ প্রকল্পের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে আমরা মানবিক আচরণ, নিজেদের অধিকার, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের গুরুত্ব, নিজেদের মধ্যে ও স্থানীয়দের সাথে ভাল আচরণ এবং সহিষ্ণুতার শিক্ষা পেয়েছি। সবচেয়ে বড়কথা হল ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’ এর প্রয়োজনীয়তা আমরা মন থেকে উপলব্ধি করছি এবং নিজেরাই এ বিষয় নিয়ে নিজের পরিবারে, চায়ের দোকানে ও বিভিন্ন জমায়েতে প্রতিবেশীদের সাথে আলোচনা করি। খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগীতা আমাদের ইতিবাচক কর্মকান্ডে যুক্ত রাখছে,বিপথগামী হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করছে, দুশ্চিন্তা হ্রাস করছে। দুঃখভারাক্রান্ত নিরানন্দ ক্যাম্পজীবনে একটুখানি আনন্দঘন পরিবেশ আমাদের মাঝে নতুনভাবে বাঁচার আশা জাগায়। এ ধরণের কর্মসূচী অব্যাহত রাখার পাশাপাশি তিনি যুবসমাজের জীবন দক্ষতা উন্নয়নে কারিগরি প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। আর্থিক ও পরিবেশগত ক্ষতি বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশীদের জীবনমান ও দক্ষতার উন্নয়নেও সরকার ও দাতাসংস্থারা এগিয়ে আসলে তা ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’ নিশ্চিতে সহায়ক হবে বলে আলোচনায় অংশ নেয়া অন্যান্য রোহিঙ্গারাও আশাপ্রকাশ করেন।
Discussion about this post