
স্ত্রী আর এক সন্তান বেঁচে নেই। আতাউর রহমানের হৃদয়ভাঙা আহাজারি কোনো সান্ত্বনা মানছিল না। অবুঝ আরেক সন্তানকে প্রবোধ দেবে কে? গতকাল চট্টগ্রামে গ্যাসলাইন বিস্ফোরণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া ভবন ইনসেটে।জনতা ফার্মেসী’ নামের ওষুধের দোকানটি খুলে ঝাড়ু দিচ্ছিলেন কর্মচারী অনুপম ঘোষ। ঠিক তাঁর পাশেই প্রতিদিনের মতো পানের দোকান খুলে বিকিকিনি শুরু করেছেন মঞ্জুর হোসেন। সেই দোকানে চা-নাশতা খেয়ে পান চিবুচ্ছিলেন রংমিস্ত্রি নুরুল ইসলাম। ঠিক সেই সময় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ। উড়ে আসা ইট-পাথরের আঘাতে মুহূর্তেই প্রাণবন্ত নুরুল ইসলাম ঢলে পড়লেন মাটিতে। হঠাৎ করেই যেন ধ্বংসস্তূপ! রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে শিশু-নারীসহ কমপক্ষে ২০ জনের রক্তাক্ত দেহ। ঘটনাস্থলেই তিনজন এবং হাসপাতালে নেওয়ার পর আরো চারজন মারা যান এই রহস্যময় বিস্ফোরণে। গতকাল রবিবার সকাল ৯টার দিকে চট্টগ্রামের পাথরঘাটার ব্রিকফিল্ড রোডের বড়ুয়া ভবনের নিচতলায় এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।প্রাথমিকভাবে গ্যাসলাইনের পুরনো পাইপের লিকেজ থেকে বের হওয়া গ্যাস জমে এই বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে। সকালে চুলায় আগুন ধরানোর সঙ্গে সঙ্গে এই বিস্ফোরণ ঘটে। আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, পূজার ঘরে মোমবাতি জ্বালাতে দিয়াশলাই ধরাতেই প্রচণ্ড শব্দে ঘরটি বিস্ফোরিত হয়। এই ঘটনায় জেলা প্রশাসন ও পুলিশের পক্ষ থেকে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী সাত দিনের মধ্যে ঘটনার কারণ চিহ্নিত করে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত সাতজনের মধ্যে চারজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন পটিয়া মেহের আটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এ্যানি বড়ুয়া (৪২), রংমিস্ত্রি নুরুল ইসলাম (৩১), জুলেখা খানম ফারজানা (৩০) ও তাঁর বড় ছেলে পাথরঘাটা সেন্ট প্লাসিডস স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র আতিকুর রহমান শুভ (১০)। নিহতরা সবাই ছিলেন পথচারী।এ ঘটনায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত ১০ জনের মধ্যে নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে পাঁচজনের। তাঁরা হলেন মো. ইউসুফ (৪০), মো. হামিদ (৪০), সন্ধ্যা রানী দেবী (৪৫), অর্পিতা নাথ ও ডরিন তৃষ্ণা গোমেজ।চমেক হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আখতারুল ইসলাম বলেন, ‘পাথরঘাটার ঘটনায় আহতদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাঁদের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে। আহতদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে।বার্ন ইউনিটের সহকারী রেজিস্ট্রার নারায়ণ চন্দ্র ধর বলেন, ‘বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অর্পিতা নাথের (১৫) শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তার শরীরের ৩০ শতাংশ পুড়ে গেছে এবং শ্বাসনালিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে কথা হয় প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় বাসিন্দা অমিত দাশের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শুনে প্রথমে ভয় পাই। কিছুক্ষণ পর সাহস করে যখন বের হই তখন দেখি, পুরো এলাকা কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। নাশকতা নাকি দুর্ঘটনা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সাহস করে আরেকটু এগোতেই দেখি নারী, শিশু আর পুরুষের কাতরানোর আওয়াজ। পরে এলাকার লোকজন দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে দেয়ালচাপা অবস্থা থেকে তুলে ঘটনাস্থলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাক ও ভ্যানগাড়িতে করে হতাহতদের চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়।বিস্ফোরণের ঘটনায় বড়ুয়া ভবনের আশপাশের ভবনগুলোও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাস্তার অন্য পাশে থাকা বাদশা মিয়া ভবন। এই ভবনের নিচতলায় অবস্থিত জনতা ফার্মেসীর ভেতরে পর্যন্ত বিস্ফোরণের ছবি দেখা যায়। ফার্মেসির মালিক টিটু কুমার নাথ বলেন, ‘ভগবানের দোয়ায় একটুর জন্য আমার কর্মচারী অনুপম বেঁচে গেছে। সে তখন দোকান খুলে ঝাড়ু দিচ্ছিল। ঝাড়ু দিতে দিতে দোকানের যে পাশটির গ্রিলের দরজা খোলেনি সেই পাশটিতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বোমার শব্দে হুড়মুড় করে ইটের টুকরাসহ বিভিন্ন সামগ্রী দোকানে ভেঙে পড়ে।প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নিহতদের মধ্যে একজন ছিলেন রিকশাচালক, যিনি স্কুল শিক্ষিকা এ্যানী বড়ুয়াকে নিয়ে কোতোয়ালি মোড়ে যাচ্ছিলেন। নিহত নাম-না-জানা আরেকজন ভ্যানচালক। তিনি দুর্ঘটনার সময় ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন।বিস্ফোরণের কারণ : চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘যতটুকু শুনেছি, লাইনের গ্যাসের লিকেজ থেকেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। সারা রাত ধরে লিকেজের জমে থাকা গ্যাস সকালে ঘরের কোনো সদস্য রান্নার জন্য চুলার আগুন ধরাতেই বিস্ফোরিত হয়।তবে ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে বিস্ফোরণের ঘটনায় চিকিৎসাধীন সন্ধ্যা রানী দেবীর কাছ থেকে। বিস্ফোরণের ঘটনাটি তাঁর ঘরেই ঘটেছে। সন্ধ্যা রানী দুর্ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘সকালে পূজার ঘরে গিয়ে মোমবাতি জ্বালানোর জন্য দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালাতেই বিস্ফোরণ হয়। কিভাবে কী হয়েছে বুঝতেও পারিনি।’ এই ঘটনায় সন্ধ্যা রানীর বড় বোনের মেয়ে অর্পিতা নাথও পুড়ে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অর্পিতার বাবা কাজল দেবনাথ গ্রামের বাড়িতে যাওয়ায়, মা মণিবালা নাথ কর্মস্থলে থাকায় এবং ভাই অর্ণব নাথ বাইরে নাশতা খেতে যাওয়ায় দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যান।চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক পূর্ণচন্দ্র মুত্সুদ্দী দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে বলেন, ‘গ্যাসের রাইজার, যেটি সাধারণত গ্যাসের চাপ নিয়ন্ত্রণ করে, সেই রাইজারটি ছিল বড়ুয়া ভবন ও পাশের জসিম ভবনের মাঝখানে দেয়ালের ফাঁকে। সেটিও দেয়াল দিয়ে ঘেরা। কিন্তু রাইজার সব সময় ফাঁকা জায়গায় রাখতে হয়। সাধারণত রাইজার থেকে সব সময় কিছু গ্যাস বের হয়। ফাঁকা জায়গায় আলো-বাতাসে থাকে বলে সেখানে আগুন ধরে না। কিন্তু বড়ুয়া ভবনের রাইজারটি বদ্ধ জায়গায় হওয়ায় সেখানে গ্যাস জমে ছিল। এর মধ্যে কাল রাতের কোনো এক সময় অনেক দিনের পুরনো জং ধরা রাইজার থেকে গ্যাস লিকেজ হয়ে সেটি অনেকটা বারুদ হয়েছিল। সকালে চুলার আগুন কিংবা পূজার ঘরের মোমবাতি জ্বালাতে দিয়াশলাই জ্বালাতেই সেটি বিকট আওয়াজে বিস্ফোরিত হয়। সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজে যেটি দেখেছি, ঘনবসতি এলাকার ওই জায়গাটিতে মানুষ সাধারণত রিকশার জন্য অপেক্ষা করে। এ কারণে বিস্ফোরণে দেয়াল ভেঙে পথচারীদের চাপা দেয়। এতে ক্ষয়ক্ষতিও অনেক বেশি হয়েছে।দুই তদন্ত কমিটি : বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় জেলা প্রশাসন ও মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে দুটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন বিস্ফোরণে হতাহতের খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করার কথা জানান। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ জে এম শরিফুল হাসানকে প্রধান করে গঠিত এই কমিটিতে ফায়ার সার্ভিস, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), বিস্ফোরক অধিদপ্তর এবং স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর সদস্য হিসেবে থাকবেন।চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির নেতৃত্ব দেবেন উপকমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মেহেদী হাসান। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন নগর বিশেষ শাখার অতিরিক্ত উপকমিশনার মঞ্জুর মোরশেদ ও কোতোয়ালি জোনের সহকারী কমিশনার নোবেল চাকমা।শিক্ষা উপমন্ত্রী ও চসিক মেয়রের অনুদান : নিহতদের প্রত্যেকের দাফন ও প্রাথমিক কাজের জন্য ১০ হাজার টাকা করে অনুদান দিয়েছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় সংসদ সদস্য ও শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। এদিকে গতকাল দুপুরে চসিক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন আহতদের দেখতে হাসপাতালে গিয়ে নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে এক লাখ টাকা দেওয়ার ঘোষণা দেন।
Discussion about this post